অহংকার: ধ্বংসের অন্যতম কারণ

অহংকার: ধ্বংসের অন্যতম কারণ

অহংকার—একটি আত্মিক ব্যাধি, যা মানুষকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। কোরআন ও হাদিসে অহংকারকে সকল পাপের মূল বলা হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অহংকার-ই বহু জাতি ও ব্যক্তির পতনের কারণ হয়েছে। এই ব্লগে আমরা বিশ্লেষণ করবঃ কেন অহংকার ধ্বংসের অন্যতম কারণ এবং কীভাবে ইসলাম আমাদের এই রোগ থেকে মুক্ত থাকতে নির্দেশ দেয়।


তাহলে এবার শুরু করা যাক মূল আলোচনা। অহংকার প্রকৃত অর্থে কতটা ধ্বংসাত্মক এ আলোচনার মাধ্যমেই উঠে আসবে তার প্রকৃত রূপ।

সূচিপত্র

অহংকারের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি

অহংকার বা 'তাকাব্বুর' শব্দটির অর্থ হচ্ছে—নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবা, নিজের গুণাবলিকে অতিরঞ্জিত করে দেখা এবং অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। এটি এমন একটি মানসিক রোগ যা মানুষকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়। ইসলামে অহংকারকে একটি মারাত্মক গুনাহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।রাসূল (সা.) বলেন:

“যার অন্তরে একটি সরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”
— সহীহ মুসলিম, হাদিস: ৯১

অহংকারের কারণসমূহ

মানুষ নানান বিষয় নিয়েই অহংকার করে থাকে। অহংকারী ব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রে বুঝতেও পারে না; সে তার কথা-বার্তা বা কাজের মাধ্যমে কতটা অহংকারী ভাব প্রদর্শন করে চলেছে। তাই মানুষ সাধারণত যে সকল বিষয় নিয়ে অহংকার করে থাকে তার কয়েকটি তুলে ধরা হলো-
  • জ্ঞানের অহংকার
  • ধন-সম্পদের গর্ব
  • পদমর্যাদা ও ক্ষমতার দম্ভ
  • বাহ্যিক সৌন্দর্যের অহংকার
  • ইবাদতের গর্ব (রিয়া)

অহংকারের মূল উপাদান:

অহংকারের মূল উপাদান দুইটি
  • ১/ যে কোন বিষয়ে নিজেকেই সেরা বা শ্রেষ্ঠ মনে করা
  • ২/ নিজের শ্রেষ্ঠত্বের কাছে অন্যদেরকে একেবারেই তুচ্ছ বা নগণ্য বিবেচনা করা



মূলতঃ যেকোনো ব্যক্তির মাঝে যখন এই দুইটি বিষয় দানা বাধে, তখনই সে হয়ে ওঠে প্রচন্ড দাম্ভিক ও অহংকারী।আর এর পরই শুরু হয় মূল সমস্যা—

অহংকারী ব্যক্তি সকলকে অগ্রাহ্য করতে থাকে
বড়ত্ব বজায় রাখতে সে সত্যকেও প্রত্যাখ্যান করে
তার ব্যবহারিক নমনীয়তা হ্রাস পায়
মানুষের মর্যাদা কে ভূলুণ্ঠিত করে
এবং এক পর্যায়ে এসে সমাজের সকলের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কোরআনের আলোকে অহংকার

পবিত্র কোরআনে অহংকারের বিরুদ্ধে বহুবার সতর্ক করা হয়েছে। ইবলিসের কাহিনি হচ্ছে অহংকারের প্রথম উদাহরণ:

#“সে অস্বীকার করল এবং অহংকার করল, ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।”
— সূরা বাকারা: ৩৪

শয়তান বলেছিল:

#“আমি আগুন থেকে সৃষ্টি, আর সে (আদম) মাটি থেকে। আমি কেন তাকে সিজদা করব?”
— সূরা আরাফ: ১২

এই অহংকারই তাকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করে এবং চিরকালীন অভিশপ্ত করে তোলে।

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:

#“তুমি অহংকার করে মানুষের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিও না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দাম্ভিককে পছন্দ করেন না।”
— সূরা লোকমান: ১৮

হাদীসে অহংকারের ভয়াবহতা

রাসূল (সা.) অহংকার সম্পর্কে অনেক সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।

*"যে ব্যক্তি তার হৃদয়ে এক তিল পরিমাণ অহংকার ধারণ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।" – সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯১:

*"তিন ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করা হবে: এক—অহংকারী শাসক।” – তিরমিজি, হাদীস ১৯৯৩:

*নবীজী (সা.) স্পষ্টভাবে বলেছেন, অহংকার মানুষকে জান্নাত থেকে বঞ্চিত করে। এবং আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট বান্দাদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো—”অহংকার”।অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) অহংকারকে সবচেয়ে ভয়ংকর আত্মিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন:--

*“আল্লাহ বলেন, গর্ব আমার চাদর এবং অহংকার আমার আবরণ। যে কেউ এ দুটির মধ্যে কোনো একটি নিয়ে টানাটানি করবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।”
— সহীহ মুসলিম: ২৬২০

এছাড়া কেয়ামতের দিন অহংকারীদের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে:--

*“তাদেরকে পিঁপড়ার মতো ক্ষুদ্র করে মানুষের রূপে উঠানো হবে এবং অপমান ও লাঞ্ছনা তাদের ঘিরে ধরবে।”
— তিরমিজি: ১৯৯৮

ঐতিহাসিক শিক্ষা: অহংকারের পরিণতি

অহংকার এর কারণে খুব অল্প সময়েই মানুষ কিছু মারাত্মক পরিণতির শিকার হয় । যেমন–

  • আত্মিক অন্ধত্ব: সত্য গ্রহণে অনীহা
  • মানবিক সম্পর্কের অবনতি: মানুষ দূরে সরে যায়
  • আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া
  • জাহান্নামের শাস্তি: কোরআন ও হাদিসে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।



আর ইতিহাসে রয়েছে এর মারাত্মক পরিণতির বহু উদাহরণ–

*ফিরআউন: নিজেকে “রব্বুল আ’লা” দাবি করেছিল। তার অহংকারের পরিণতিতে সে ও তার বাহিনী নীল নদে ডুবে ধ্বংস হয়।


*নমরুদ: ইব্রাহিম (আ.)-এর সঙ্গে বিতর্ক করে নিজেকে ঈশ্বর দাবি করেছিল। আল্লাহ একটি মশার মাধ্যমে তাকে ধ্বংস করেন।


*কারুন: তার ধন-সম্পদের অহংকারে মাটির নিচে বিলীন হয়ে যায়।

এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, অহংকার কখনো স্থায়ী হয় না—বরং তা ধ্বংসের পূর্বাভাস।

অহংকার থেকে মুক্তির উপায়

১. আত্মচিন্তা ও আত্মসমালোচনাঃনিজের ভেতরের দম্ভ ও গর্বের অনুভূতিগুলো চিহ্নিত করা।প্রতিদিন নিজেকে জিজ্ঞেস করা: আমি কি কাউকে তুচ্ছ ভাবছি?

২. তাওহিদ বা আল্লাহর মহত্বের উপলব্ধিঃ এটা বুঝা যে, সব কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ।
নিজের দুর্বলতা এবং সীমাবদ্ধতা স্বীকার করা।

৩. নম্রতা ও বিনয় চর্চাঃঅহংকারী আচরণ এড়িয়ে চলাসকলের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করা, বিশেষ করে  যাদের অবস্থা দুর্বল বা নিচু বলা হয়।

৪. সত্য গ্রহণে প্রস্তুত থাকাঃ নিজের ভুল স্বীকার করা। অন্যের উপদেশ গ্রহণে বাধাগ্রস্ত না হওয়া

৫. ইবাদতের খালিস নিয়ত বজায় রাখা। নিজের ইবাদত বা ভালো কাজ নিয়ে গর্ব না করা
রিয়া (লোক দেখানো আমল) পরিহার করা

৬. ঐতিহাসিক উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া।ফিরআউন, কারুন, নমরুদের মতো অহংকারী নেতাদের পরিণতি স্মরণ রাখা

৭.বিনয়ের শক্তিকে অনুধাবন করা—যেমন রাসূল (সা.)-এর জীবন

সর্বোপরি দুআ করা: অর্থাৎ অহংকার থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া।

উপসংহার:

অহংকার মানুষের একটি মারাত্মক চারিত্রিক দোষ, যা ধীরে ধীরে তার জ্ঞান, বিনয়, মানবতা এবং সামাজিক মর্যাদাকে ধ্বংস করে দেয়। যিনি অহংকারী, তিনি নিজেকে সবসময় শ্রেষ্ঠ মনে করেন এবং অন্যকে তুচ্ছজ্ঞান করেন — ফলে সমাজে বিভেদ ও বিদ্বেষ জন্ম নেয়। ধর্মীয় দৃষ্টিতেও অহংকার একটি গুরুতর গুনাহ, যা শয়তানের স্বভাব। একজন মানুষ যত বড়ই হোক না কেন, বিনয়ই তাকে প্রকৃত অর্থে মহত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করে। তাই প্রকৃত জ্ঞানী ও সভ্য মানুষ কখনো অহংকারী হন না। জীবনে সত্যিকারের সম্মান ও সফলতা পেতে চাইলে অহংকার পরিহার করে নম্রতা ও বিনয়কে আলিঙ্গন করাই শ্রেয়।


যদি আমাদের আজকের আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আরো সুন্দর সুন্দর ও প্রয়োজনীয় আর্টিকেল পেতে সব সময় ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইট– www.kawminews.com










এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url