ঘূর্ণিঝড়ের ছায়ায় বাংলাদেশ: আমরা কতটা প্রস্তুত?
ঘূর্ণিঝড়ের ছায়ায় বাংলাদেশ: আমরা কতটা প্রস্তুত?
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান একদিকে যেমন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের সৌগন্ধে ভরপুর, অন্যদিকে তা দুর্যোগেরও এক সুগভীর খেলার মঞ্চ। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়—যা প্রায় প্রতি বছরই দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে হানা দেয়।
যা এখন আর কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং একটি জাতীয় নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য চ্যালেঞ্জও ।
সূচিপত্রঃ ঘূর্ণিঝড়ের ছায়ায় বাংলাদেশ
- দুর্যোগের পূর্বাভাস ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
- সরকারি পদক্ষেপ ও নাগরিক দায়িত্ব
- ঘূর্ণিঝড়ে সকলের জন্য করণীয়
- জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
- উপসংহার
দুর্যোগের পূর্বাভাস ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস ব্যবস্থাও উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর বর্তমানে স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, রাডার সিস্টেম এবং সফিস্টিকেটেড পূর্বাভাস মডেল ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ ও তীব্রতা নির্ধারণ করতে পারছে অনেক আগে থেকেই।
এসব তথ্য টেলিভিশন, মোবাইল ম্যাসেজ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে– সঠিক সময়ে দুর্গম এলাকা গুলোতে বার্তা পৌঁছে দেওয়া ও সেখান থেকে সময়মত প্রতিক্রিয়া নেওয়ার ব্যপারে।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ১৪ হাজারের বেশি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও সবগুলো জায়গায় তা যথেষ্ট নয়। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ, খাবার-পানির সরবরাহ এবং স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতিও কিছু এলাকায় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি পদক্ষেপ ও নাগরিক দায়িত্ব
সরকার ইতিমধ্যেই জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি, সাইক্লোন প্রিপারডনেস প্রোগ্রাম (CPP), ও স্থানীয় দুর্যোগ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছে। এছাড়াও রয়েছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও রেড ক্রিসেন্ট-এর মতো সংস্থার দ্রুত রেসপন্স ইউনিট।
প্রতিটি নাগরিকের জন্য অবশ্য পালনীয় কিছু দায়িত্ববোধ মুলক কাজ হতে পারে–
পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া
প্রতিবেশীদের সাহায্য করা, বিশেষ করে নারি, বয়স্ক ও অক্ষমদের
জরুরি ব্যাগ প্রস্তুত রাখা (চাল, পানি, ওষুধ, টর্চলাইট)
গবাদিপশু ও সম্পদের নিরাপদ ব্যবস্থা করা
এসব ছোট ছোট উদ্যোগ মিলেই একটি বড় দুর্যোগ মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে।
ঘূর্ণিঝড়ে সকলের জন্য করণীয়
ঝড়ের আগে প্রস্তুতি:
আবহাওয়ার সতর্কতা শুনুন: রেডিও, টিভি বা মোবাইল অ্যাপে নিয়মিত আপডেট নিন।
আশ্রয়কেন্দ্র চিহ্নিত করুন: নিকটস্থ সাইক্লোন সেন্টার বা নিরাপদ ভবনের অবস্থান জেনে রাখুন।
ঘূর্ণিঝড় ব্যাগ প্রস্তুত করুন: জাতীয় পরিচয়পত্র, ওষুধ, শুকনো খাবার, পানি, টর্চ, মোবাইল চার্জার, কিছু নগদ টাকা রাখুন।
বাড়ির ঝুঁকিপূর্ণ অংশ ঠিক করুন: ছাদ, জানালা, দরজা ভালোভাবে বেঁধে দিন। ছাদে ভারী বস্তু থাকলে সরিয়ে ফেলুন।
ঘরের ভেতরে থাকুন: দরজা-জানালা বন্ধ রাখুন, কাঁচের জানালায় বোর্ড লাগান।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ করুন: বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
মোমবাতির বদলে টর্চ ব্যবহার করুন: আগুন লাগার ঝুঁকি কমাতে।
শিশু ও বৃদ্ধদের নিরাপদে রাখুন: তাদের একা বাইরে যেতে দেবেন না।
গুজবে কান দেবেন না: শুধুমাত্র সরকারি বা নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুসরণ করুন।
ঝড়ের পরে করণীয়:
বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করুন: ভাঙা গাছ, কাঁচ, বৈদ্যুতিক তার সরিয়ে ফেলুন।
পানীয় জল ফুটিয়ে খান: দূষিত পানিতে রোগ ছড়াতে পারে।
বিদ্যুৎ সংযোগ চালুর আগে পরীক্ষা করুন: বিশেষজ্ঞ দিয়ে চেক করান।
প্রতিবেশীদের সাহায্য করুন: বিশেষ করে অসুস্থ, বৃদ্ধ বা শিশুদের
জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
দুঃখজনক হলেও সত্য, ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি ও ঘনত্ব দিন দিন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগরের পানির উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে, যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে আরও বেশি তীব্র ও আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়।
বিশ্বব্যাপী গবেষণা বলছে, আগের তুলনায় আজকের ঘূর্ণিঝড়গুলো অধিক ক্ষতিকর ও অনিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশও এই পরিবর্তনের শিকার। উপকূলীয় জনপদগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ছে, কৃষি হুমকির মুখে পড়ছে এবং মানুষ বাধ্য হচ্ছে ঘরবাড়ি ছাড়তে।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রয়োজন:
জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো তৈরি
উপকূলীয় বন ও কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ
আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলে সমর্থন চাওয়া
স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন কৌশল গ্রহণ করা
উপসংহার
ঘূর্ণিঝড়কে পুরোপুরি প্রতিহত করা সম্ভব নয়, তবে প্রস্তুতি, সচেতনতা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকলে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি ব্যক্তি ও সামাজিক স্তরেও দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।বিশেষতঃ উপকূলীয় অঞ্চল ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য এক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অপরিহার্য, নতুবা সামান্য ভুলের মাশুল হতে পারে অত্যন্ত মর্মান্তিক।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url