সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের ইতিহাস

 



সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের ইতিহাস


সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। একটি নাম একটি ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় তার নাম লেখা আছে গর্ব, সাহস ও ঈমানের প্রতিচ্ছবি হিসেবে। ১১৮৭ সালে তিনি খ্রিস্টানদের কাছ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস তথা জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে ইসলামী ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন একাধারে একজন ইসলামিক জ্ঞানের অধিকারী পরহেজগার ব্যক্তিত্ব।  অন্যদিকে ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা সাহসী  গভর্নর ও পরবর্তীতে একজন  ন্যায়নিষ্ঠ সুলতান। তার কীর্তি এখনো নাড়া দেয় লাখো যুবকের হৃদয়ে।




আজ এই ব্লগে আমরা জানবো তার জেরুজালেম বিজয়ের কাহিনী।ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর আলোকে তার জীবন চরিত সম্পর্কেও কিছু আলোকপাত করা হবে এই আর্টিকেলে। তাহলে চলুন যাওয়া যাক মূল আলোচনাইয়।


সূচিপত্র 



তৎকালীন প্রেক্ষাপট ও ক্রূসেড  যুদ্ধ

১০৯৯ সালে ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা জেরুজালেমে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। মুসলিমদের পাশাপাশি কিছু সংখ্যক ইহুদিরাও সে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। ইসলামী বিশ্বের জন্য এই ঘটনা ছিল এক চরম আঘাত। এরপর ১১ শতকের শেষ ভাগে ইউরোপীয় ক্রিস্টানরা প্রথম ক্রূসেড যুদ্ধের মাধ্যমে জেরুজালেম দখল করে নাই। 



ব্যক্তি সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রহমতুল্লাহি (রহ.)

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী (রহঃ), যিনি পশ্চিমা বিশ্বে সালাদিন নামে পরিচিত, তিনি ছিলেন ইসলামের এক কিংবদন্তি বীর এবং ন্যায়পরায়ণ শাসক। তাঁর পূর্ণ নাম ছিল আবু নাসির সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। তিনি ১১৩৭ / ১১৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান ইরাকের তিকরিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১৯৩ সালের ৪ মার্চ সিরিয়ার দামেস্কে ইন্তেকাল করেন।

তিনি ছিলেন কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর পিতা নাজমুদ্দিন আইয়ুব ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। যিনি তিকরিত অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। সালাহউদ্দিন ছোটবেলা থেকেই দামেস্কে বেড়ে ওঠেন এবং ইসলামি জ্ঞান ও সামরিক কৌশলে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

তাঁর রাজনৈতিক ও সামরিক জীবন শুরু হয় ফাতেমীয় মিশরে, যেখানে তিনি প্রথমে উজির নিযুক্ত হন এবং পরে ফাতেমীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে মিশরকে আব্বাসীয় খিলাফতের অধীনে আনেন। ১১৭৪ সালে সিরিয়ার শাসক নূরউদ্দিন জনগির মৃত্যুর পর তিনি সিরিয়া জয় করেন এবং মিশর-সিরিয়ার একক সুলতান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

সালাহউদ্দিনের সবচেয়ে স্মরণীয় কীর্তি হলো ১১৮৭ সালের হাত্তিনের যুদ্ধে ক্রূসেডারদের পরাজিত করে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার। এই বিজয় তাঁকে মুসলিম বিশ্বের বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং তাঁর উদারতা ও ন্যায়বিচার তাঁকে ইউরোপীয় ইতিহাসেও সম্মানিত করে তোলে।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন বিনয়ী, দানশীল এবং ধর্মপ্রাণ। মৃত্যুর সময় তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ প্রায় নিঃশেষ ছিল, কারণ তিনি অধিকাংশই দান করে দিয়েছিলেন। তাঁকে দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের পাশে দাফন করা হয়। সেখানে তিনি আজও  শায়িত রয়েছেন।

ইতিহাসে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী শুধু একজন যোদ্ধা নন, বরং এক আদর্শ শাসক ও মানবিক নেতা হিসেবেই স্মরণীয়। তাঁর জীবন আজও অনুপ্রেরণার উৎস। লাখো তরুণ আজও তার উত্তরসূরি হিসেবে নিজেদেরকে  গর্বিত বলে মনে করে।। 


হেত্তিনের যুদ্ধ  (ব্যাটল অফ হেত্তিন) 

১১৮০ সালের চৌঠা জুলাই সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রতিপক্ষ ক্রিস্টান বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি নির্ণায়ক বিজয় অর্জন করেন।  এই যুদ্ধে জেরুজালেমের খ্রিস্টান রাজার বাহিনী পরাজিত  হয়ে তাদের বহু সৈন্য বন্দী হয়। এতে করে বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের দ্বার খুলে যায়।


বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার

১১৮৭ সালের ২রা অক্টোবর সালাহউদ্দিন শান্তিপূর্ণভাবে জেরুজালেম দখল করেন। তিনি প্রতিশোধের পথে না হেঁটে দয়া ও সহানুভূতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। 

২ অক্টোবর ১১৮৭ খ্রিষ্টাব্দ—ইতিহাসের এক গৌরবময় দিন। এই দিনেই সালাহউদ্দিন আইয়ুবী (রহঃ) খ্রিস্টান ক্রূসেডারদের কাছ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম) পুনরুদ্ধার করেন।


এই ঐতিহাসিক দিনের বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্য হতে কয়েকটি ছিল নিম্নরূপ  –

  • শহর অবরোধ ও আত্মসমর্পণ: দীর্ঘ অবরোধের পর খ্রিস্টানরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। সালাহউদ্দিন প্রতিশোধের পথ না বেছে নিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দেন। তিনি নিরীহ নাগরিকদের নিরাপদে শহর ত্যাগের সুযোগ দেন, যা সেই সময়ের জন্য ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত।

  • মানবিকতা ও উদারতা: মুসলিম বাহিনী বিজয়ের পর শহরে কোনো গণহত্যা চালায়নি। বরং সালাহউদ্দিন বন্দিদের মুক্তির সুযোগ দেন মুক্তিপণ বা বিনিময়ের মাধ্যমে। অনেক গরিব খ্রিস্টানকে তিনি নিজ খরচে মুক্ত করে দেন।

  • আল-আকসা মসজিদের পুনরুদ্ধার: শহর পুনর্দখলের পর মুসলিমরা আল-আকসা মসজিদকে পুনরায় ইসলামী ইবাদতের জন্য প্রস্তুত করে। সেখানে বহু বছর আগে তৈরি এক কাঠমিস্ত্রির মিম্বার স্থাপন করা হয়—যা সালাহউদ্দিন নিজ হাতে সংরক্ষণ করেছিলেন এই দিনের জন্য।

এই দিনটি শুধু একটি শহর পুনরুদ্ধারের নয়, বরং তা ছিল আত্মত্যাগ, বিশ্বাস ও ন্যায়বিচারের বিজয়। সালাহউদ্দিনের এই আচরণ ইউরোপীয় ইতিহাসেও তাঁকে একজন সম্মানিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

বিপরীতে ১০৯৯ সালের খ্রিষ্টান দখলের সময় মুসলমানদের উপর চালানো হয়েছিল নির্মম  গণহত্যা।ইতিহাসের পাতায় যা আজও ক্রুসেডারদের পাশবিকতার নিদর্শন হয়ে আছে । 


বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের তাৎপর্য

এ বিজয় শুধু একটি শহর দখলের ঘটনা ছিল না বরং এটি মুসলিম উম্মার জন্য আত্মমর্যাদা ফিরে পাওয়ার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল সালাহউদ্দিনের দয়া ন্যায় বিচার ও শত্রুর প্রতি ও সম্মান প্রদর্শন, আজও বিশ্ব ইতিহাসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।


লেখকের কথা

ইতিহাসের অধ্যয়ন কেবল আত্ম তৃপ্তির জন্য নয় বরং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে সেই মতো গড়ে তোলাই হোক লক্ষ্য। প্রতিটি তরুণের হৃদয়ে জাগরিত হোক সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর আদর্শ ও ব্যক্তিত্বের প্রতি আকর্ষণ। বর্তমান সময়ের  সালাহউদ্দীনেরা জেগে উঠুক পুনরায় ।।


আর্টিকেলটি ভালো লাগলে কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না । আপনাদের অনুপ্রেরণাই আমাদের আগামীর পথচলা। 


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url